আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং বিশিষ্ট রাজনীতিক বেগম মতিয়া চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন। আজ দুপুরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এভারকেয়ার হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ নিশ্চিত করেছেন যে মতিয়া চৌধুরী বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন এবং সংগ্রাম ছিল বহুমাত্রিক এবং প্রভাবশালী। ১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মতিয়া চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন সংগ্রামী। তার পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমানের সাথে, যা তার ব্যক্তিগত জীবনেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল।
ছাত্রজীবনে ইডেন কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় করে তোলে। ১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের কার্যকরী কমিটির সদস্য হন। সেই সময় থেকেই তিনি ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন, যা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সংগ্রামী মানসিকতার প্রতীক ছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা, আহতদের চিকিৎসা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের পক্ষে তদবিরের একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৭১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দলের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরশাদ এবং জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বেশ কয়েকবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তবে প্রতিবারই তিনি দৃঢ় মনোবল নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মতিয়া চৌধুরী তিনবার বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন—১৯৯৬, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে। তার কৃষিনীতির কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল, যা তাকে একজন দক্ষ এবং সফল মন্ত্রীর পরিচয় এনে দিয়েছিল। কৃষকদের স্বার্থরক্ষা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তিনি সব সময়ই কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদের উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করেছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। সংখ্যালঘু নারীদের সম্পত্তিতে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, হিন্দু আইনের সংস্কার এবং নারী অধিকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন।
২০২৪ সালে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন, যার ফলে মতিয়া চৌধুরী সংসদ সদস্য পদ হারান। তবে তার রাজনৈতিক ভূমিকা এবং সংগ্রামী মানসিকতা তাকে দেশের ইতিহাসে একজন অমর নেতা হিসেবে স্মরণীয় করে রাখবে।
মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন কেবলমাত্র রাজনীতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন একজন মানবিক নেতা, যিনি সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, যা সহজে পূরণ হবার নয়।